জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু পৃথিবী তো আয়তনে বড় হচ্ছে না। বেশী আয় ও উন্নত জীবনের জন্য সবাই ছুটছেন শহরে। ফলে, শহরের উপরে চাপ বাড়ছে; আর এতেই শহরের অ্যাপার্টমেন্টগুলোও ছোট হতে শুরু করেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত সব জিনিষপত্রগুলো রাখার ফলে এ্যাপার্টমেন্টগুলো হয়ে গেছে বস্তির মত ঘিঞ্জি।
শুনে অবাক হচ্ছেন, এত ছোট এ্যাপার্টমেন্ট হয় নাকি!
কিন্তু, পাঠকদের জন্য এই লেখাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এমন কিছু মিনি এ্যাপার্টমেন্টের কথা তুলে ধরব, সেগুলো থেকে ঐ শহরগুলোতে জীবনযাত্রার ব্যয় ও বাসস্থানের নিদারুণ অপ্রতুলতার কথা প্রতিটি শব্দে শব্দে উঠে আসবে।
সেখানে বাসস্থানের ব্যয় সংস্থান করতে তারা রুমমেট নিয়ে ব্যয় ভাগাভাগি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর, বাস্তবতার কথা চিন্তা করে বাসিন্দাদের এই ব্যবস্থা মেনে নেয়া ছাড়া কোন গত্যান্তর নাই।
বাংলাদেশে বসে তাদের জীবনযাত্রার এই বিচিত্র আয়োজনের কথা আমরা কল্পনা করতে পারব না। তবে, লেখার শেষ পর্যন্ত পড়লে আপনার মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসবে, “আরে! এরা এটা কিভাবে সম্ভব করল?”
সূচীপত্র
ওয়াং কুনচুন এর ১০৭ বর্গফুটের এ্যাপার্টমেন্ট

৯০ বছর বয়সী ওয়াং কুনচুন বসবাস করেন চীনের সাংহাইয়ে। সাথে থাকেন তার ছেলে, বয়স ৬০। তারা যে মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করেন তার আয়তন মাত্র ১০৭ বর্গফুট।
Micro-apartment চীনে বেশ জনপ্রিয়

চীনের গুয়ানঝৌ এ Pearl River Delta Real Estate Fair এ মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্ট প্রদর্শনী দেখানো হয়। মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্টের সাইজ থেকে চীনের আবাসন সংকটের প্রকট অবস্থা বুঝতে পারা যায়।
ছবিতে সম্ভাব্য ক্রেতাদের জন্য একটা ক্যারাভানের উপরে ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র বাসস্থান দেখার জন্য রাখা হয়েছে।
“থাকার ছোট জায়গাই এখন অনেক বড় বিষয়”

জনসংখ্যাধিক্যে ভুগতে থাকা চীনে “থাকার ছোট জায়গাই এখন অনেক বড় বিষয়”
সুচিন্তিত স্টোরেজ ব্যবস্থা শেষ ভরসা

মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ব্যবস্থা করা হয়েছে সুচিন্তিত স্টোরেজ ব্যবস্থা। প্রতি কর্নারে, প্রতিটি শূণ্য স্থানের ভাঁজে ভাঁজে এমন নিঁপূণভাবে স্টোরেজ ব্যবস্থাকে স্থাপন করা হয়েছে যাতে অনায়াসে দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিষপত্র, পোষাক, বইপত্র প্রভৃতি রাখা ও বের করা যায়।
গ্যারেজেও বাসস্থান

ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলসের বার্জার পরিবার ২০০৯ সালে তার বাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হিন। পরে তিনি তার গ্যারেজকে মডিফাই করে গড়ে তোলেন তার পরিবারে থাকার জায়গা।
বর্তমানে সেখানে তার সাথে তার স্ত্রী ও মাতাকে নিয়ে বসবাস করেন।
মুম্বাইয়ের কংক্রিট বস্তি

ইন্ডিয়ার মুম্বাই এর কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বস্তি। নাম ধারাবি। এখানে রয়েছে পৃথিবী সবচেয়ে বড় বস্তি। এখানে ঠাসাঠাসি করে বাস করেন ১০ লক্ষ মানুষ। এখানকার প্রতিটি পরিবারের বাসস্থান মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্টের আদর্শ উদাহরণ।
[adinserter block=”1″]
ধারাবি বস্তির ভাড়া স্কয়ার ফিটে

এই ধারাবি বস্তিতে ১০০ স্কয়ার ফিটের একটা ছোট এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করতে তাদের গুণতে হয় প্রতি বর্গফিট প্রতি ৩.৫ টাকা থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত।
হংকংয়ের ৬০-স্কয়ার ফিটের সুপার-মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্ট

এই ভদ্রমহিলা হংকংয়ের এই অনুবীক্ষনিক বাসাতে থাকেন; ভাড়া মাস প্রতি ৪৮৭ হংকং ডলার। এখানে তার সাথে তার ছেলে বসবাস করে।
জন-ক্রিস্টিয়ান স্টাবিলফিল্ডের ২০০-বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট

সেই তুলনায় ওয়াসিংটনের সিয়াটলের জন-ক্রিস্টিয়ান স্টাবলফিল্ডের ২০০-বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ প্রশস্তই বলা চলে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে এমন বাসা…

সম্প্রতি এক ইন্টারভিউতে স্টাবলফিল্ডের বলেন, ১২০০ ডলারে শহরের কেন্দ্রস্থলে আমার বাসাটি থাকার জন্য বেশ সস্তায় পাওয়া একটি অপশন, কি বলেন?
২০০-বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টে খোশ মেজাজে আছেন আরেক জন

স্টাবলফিল্ডের বাসস্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে ২০০-বর্গফুটের আরেকটি অ্যাপার্টমেন্টে বেশ স্বাচ্ছন্দেই আছেন আরেক জন। নাম তার, সেংচুল ইউ (Seungchul You)। অবিবাহিত ইউ বলেন, এতেই আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে।
চীনে অসচ্ছল রোগীদের স্থান এই মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্ট

চীনের হেফেই (Hefei) শহরে স্থানী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে যারা খরচ যোগাতে পারেন না, তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় পার্শ্ববর্তী ছোট অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে। এগুলোর আয়তন মাত্র ৮৬ বর্গফুট।
হংকংয়ে রুম তো নয়, যেন কবর

হংকংয়ের মূল শহরতলীতে প্রতি বর্গফুট হিসাবে রিয়েল এস্টেট অত্যন্ত অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু, থাকার তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনের তাগিদে এখানে গড়ে উঠেছে ভার্টিক্যাল রুম। আয়তন মাত্র ৩৫ বর্গফুট।
এতেই অনেকে খুশী!
ম্যানহাটনের ৩০০

গত বছর নিউইয়র্কের বাসিন্দাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে অফিসিয়াল মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্টের সাথে। এগুলো ম্যানহাটন শহরতলীর পার্শ্ববর্তী কিপ্স বে (Kips Bay) তে অবস্থিত।
এই মাইক্রো-অ্যাপার্টমেন্টগুলো কমবেশী ৩০০ বর্গফুট আয়তনের।
৩০০ বর্গফিটের প্যালেস?

অনেক সময় ৩০০ বর্গফিটের অ্যাপার্টমেন্টও রাজপ্রাসাদের মত মনে হতে পারে। ইসরাইলের লেখক এডগার গেরেট (Edgar Geret) এর নামানুসারে পোল্যান্ডের ওয়ারশতে তৈরী করা হয়েছে “দ্য কেরেট হাউস”। এই বাড়ির সবচেয়ে চাপা অংশের দৈর্ঘ্য মাত্র ৩৬ ইঞ্চি!

এই বাড়িটি এতই ছোট যে, একে একটি “ছবি” (Art) হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়। এই বিল্ডিংয়ের আর্কিটেক্ট জেকুব শেজস্নি (Jakub Szczesny), এবং কেরেট বিভিন্ন লেখক ও আর্টিস্টদের সেখানে সাময়িক অবস্থানের জন্য আমন্ত্রণ করে আনেন।

আর এই বাড়িটি ২০১২ সালে উদ্বোধন করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, এখানে মাত্র একজনের থাকবার ব্যবস্থা রয়েছে।
কং কাইউং-সুনের ২১ বর্গফুটের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে

এবার শুনুন কং কাইউং-সুনের অ্যাপার্টমেন্টের কথা। তার বাসস্থানে লিভিং স্পেসের আয়তন মাত্র ২১ বর্গফিট। একেবারে দম বন্ধ করা অবস্থা, তাই না! অবশ্য, এই স্পেসের বাইরে রয়েছে তার টয়লেট ও মাইক্রোস্কপিক রান্না ঘর।
কং থাকেন সিউলে

কং কাইউং-সুনের বাসস্থানটি গ্যাংনাম শহরতলীতে অবস্থিত। আর এটির অবস্থান সাউথ কোরিয়ার সিউলে।
৬০০ বর্গফিটে ১৯টি ফ্যামিলি ইউনিট? অবিশ্বাস্য!

এবার, বলব হংকংয়ের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের কথা। এখানে মাত্র ৬০০ বর্গফুটের মধ্যে আটানো হয়েছে ১৯টি ফ্যামিলির তাদের জীবনের গল্প বুনেন। প্রত্যেকটি ইউনিটের ভাগে ২৫ স্কয়ার ফিটও জুটে নাই। এগুলোকে বলা “কিউবিক্যাল হোমস”। দু:খের ব্যাপার হলো, স্থানীয়ভাবে এই লিভিং স্পেসকে ডাকা হয়, “কফিন হোমস”।
কফিন হোমস: ভাড়া কিন্তু কম নয়

এই কফিন ইউনিটগুলোর প্রত্যেকটিকে কাঠের প্যানেল দিয়ে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটের মাস প্রতি ভাড়া ১৫০ হংকং ডলার। পার্শ্ববর্তী জেলায় চাকুরী করেন, বা, আশে-পাশে দোকানদারি করেন, এমন মানুষগুলো এখানে বাস করেন।
হংকংয়ের খাঁচা বাড়ি

হংকংয়ের লিভিং স্পেসের আরেকটি ধরণ হল, “খাঁচা বাড়ি”। আক্ষরিক অর্থেই নেটের তৈরী খাঁচার মত ৬ ফুট বাই ২ ফিট একটু জায়গা ঘিরে দিয়ে বানানো হয়েছে কারাগারের মত থাকার জায়গাগুলো। এই খাঁচাগুলো আবার একটার উপরে আরেকটা রাখা হয়েছে।
খাঁচা বাড়িতে থাকেন শত শত প্রবীণ

হংকংয়ের প্রবীণ বাসিন্দা কং সিউ-কাউ। তার মত শত শত প্রবীণ ব্যক্তি থাকেন এই খাঁচা বাড়িগুলোতে। একটি ইউনিটে ১২টি খাঁচা রাখা হয়েছে। প্রতিটি খাঁচায় রয়েছে ১২ জন করে পরাজিত মানুষ।
বাড়ি তো না, যেন ব্রয়লার মুরগীর খাঁচা

এই সব খাঁচা বাড়িগুলোর পরিবেশ আমাদের দেশের পোল্ট্রি ফার্মের মত পুতি-গন্ধময়। এছাড়াও, অধিকাংশ খাঁচায় যে তোষক রাখা হয়েছে তাতে ছারপোকা ছাড়াও এগুলো থেকে দুর্গন্ধ উঠে আসে।
খাঁচা বাড়িতেই শেষ নি:শ্বাস

স্বস্তির ব্যাপার হল, সম্প্রতি হংকং সরকারের সুমতি হয়েছে। এই সমস্ত খাঁচা বাড়ির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা মানুষদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তাদের গোচরে এসেছে। তবে, এখানকার বাসিন্দারা ভালভাবেই জানেন মাঝে মাঝে তারা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামলেও, ঐ পর্যন্তই তাদের দৌড়। জীবনের বাকি অংশটুকু তাদের এই পরিবেশেই কাটাতে হবে।