পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে গড়ে একশত, আর, বার্ষিক গড়ে প্রায় ৩.৬ ট্রিলিয়ন বজ্রপাত হয়। বাংলাদেশের অবস্থান বজ্রপাত প্রবণ অঞ্চলে। বজ্রপাত বন্ধ বা প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই, কারণ এটা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। তবে, বজ্রপাতের সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়ে প্রাণহানি ও কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে বাড়ির টিভি, কম্পিউটার, ফ্রিজসহ সকল ইলেট্রনিক্স যন্ত্রপাতির ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা।
বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় কি কি কৌশল এবং সতর্কতা অবলম্বন করলে প্রযুক্তি পণ্যকে রক্ষা করা যায়, তাই নিয়ে এই লেখার অবতারণা।
বজ্রপাতের আভাস পেলে সব সংযোগ খুলে দিন
বজ্রপাতের আভাস পেলেই কম্পিউটার, রাউটার, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সুইচ অফ রাখতে হবে। বাসার বাইরে থাকার সময়ও বজ্রপাত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাইরে যাওয়ার আগেই কম্পিউটার, রাউটারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্যের সুইচ অফ করে দিলে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি এড়ানো যাবে।
বজ্রপাত থেকে টিভি কিভাবে সুরক্ষিত রাখবেন
বজ্রপাতের সব থেকে বেশি নষ্ট হয় টেলিভিশন। বজ্রপাত থেকে টিভি সুরক্ষিত রাখার মতো কোনো ডিভাইস আবিষ্কৃত হয়নি এখনও। টেলিভিশনের সঙ্গে ডিশের লাইনের সংযুক্ত থাকায় বজ্রপাত হলে ডিশের লাইনের মাধ্যমে সহজেই টিভির ক্ষতি করে। অনেকেই কম্পিউটারে টিভি কার্ড ব্যবহার করেন। ফলে বজ্রপাতের সময় ডিশ লাইন সংযোগ থাকায় কম্পিউটারেরও ক্ষতি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বজ্রপাতের সময় ডিশের সংযোগটি খুলে রাখুন। আশা করা যায়, আপনার টিভিটি রক্ষা পাবে।
ইন্টারনেট রাউটারের সংযোগ খুলে দিন
বজ্রপাতে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয় রাউটার ডিভাইসগুলোর। বজ্রপাতের আভাস পেলে শুধু রাউটারের লাইন বন্ধ করলেই চলবে না, রাউটার থেকে ইন্টারনেট সংযোগের ল্যান কেবলটিও খুলে রাখতে হবে। তবে যদি আপনার ইন্টারনেট সংযোগে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল ব্যবহার করা হয়, তাহলে বজ্রপাতের ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে। কেননা এসব কেবলে ধাতব তারের ব্যবহার হয় না।
সেফটি ভাল্বযুক্ত মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার
সেফটি ভাল্বযুক্ত ভালোমানের মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করতে হবে। ফলে হাই ভোল্টেজ বা বজ্রপাতের সময় মাল্টিপ্লাগের এই সেফটি ভাল্ব পুড়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সেফটি ভাল্বযুক্ত নানা ব্র্যান্ডের মাল্টিপ্লাগ বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। দেশের বাজারে এমন মাল্টিপ্লাগের মূল্য মডেলভেদে ৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনের আর্থি করা
বজ্রপাত হতে ঘর-বাড়ি ও যন্ত্রাংশ রক্ষা করতে অবশ্যিই আর্থিং করতে হবে। বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেওয়ার সময় একটা মেইন লাইন থাকে এবং অন্যটি থাকে নিউট্রাল লাইন। এই নিউট্রাল লাইনটা রড বা তার দিয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়, যাকে বলে আর্থিং (Earthing)। এটি বজ্রপাতের পর বজ্রপাতের হাই ভোল্টেজকে নিরাপদে মাটিতে নিয়ে যেতে ব্যবহৃত হয়। ফলে, বহু মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।
বজ্রপাতের সময় করণীয়
বজ্রপাত হওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হলে, সাথে সাথে সাবধানতা অবলম্বন করাই, আপনার সখের ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ও গেজেট রক্ষা করার একমাত্র উপায়। এ সময় আপনার ঘরের সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। মোবাইল ল্যাপটপ,ডিজিটাল কামেরা ইত্যাদি চার্জ করা থেকে বিরত থাকুন।
তাহলে বজ্রপাত থেকে বেঁচে যেতে পারে আপনার মূল্যবান বাবহৃত ইলেক্ট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতিসমূহ।
বজ্রপাত কেন হয়?
জলীয়বাষ্প ঘণীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হওয়ার সময় এতে প্রচুর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ (electrostatic charge) জমা হয়। মেঘ কিভাবে চার্জিত হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ মতভেদ থাকলেও, সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হচ্ছে, পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে, তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প পরমাণু বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। যে পরমাণু ইলেকট্রন হারায় তা পজিটিভ চার্জে এবং যে পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে তা নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়।
অপেক্ষাকৃত হাল্কা পজিটিভ চার্জ থাকে মেঘের উপর পৃষ্ঠে এবং ভারী নেগেটিভ চার্জ থাকে নিচের পৃষ্ঠে। যথেষ্ট পরিমাণ পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জ জমা হওয়ার পর পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণের দরুণ ইলেকট্রোস্ট্যাটিক ডিসচার্জ (electrostatic discharge) প্রক্রিয়া শুরু হয়। ডিসচার্জ তিন ভাবে হতে পারে:
(ক) মেঘের নিজস্ব পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জের মধ্যে (একে বলা হয় Intra-cloud বা, IC discharge)
(খ) একটি মেঘের পজেটিভ (+) কিংবা নেগেটিভ (-) চার্জের সাথে অন্য মেঘের নেগেটিভ (-) কিংবা পজেটিভ (+) চার্জের সাথে (একে বলা হয় Cloud-to-Cloud বা, CC discharge)
(গ) মেঘের পজেটিভ (+) চার্জের সাথে ভূমির (একে বলা হয় Cloud-to-Ground বা, CG discharge)
ডিসচার্জ হওয়ার সময় পজেটিভ (+) চার্জ থেকে নেগেটিভ (-) চার্জের দিকে বাতাসের মধ্য দিয়ে স্পার্ক আকারে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এ ঘটনাই হল বজ্রপাত।
বজ্রপাতের শাব্দিক অর্থ হলো “ভূমিতে বিদ্যুৎ পতিত হওয়া”। তবে, সব বজ্রপাতে ভূমিতে বিদ্যুৎ বা চার্জ পতিত হয় না। শুধু মাত্র CG discharge প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন বজ্রপাতে ভূমিতে বৈদ্যুতিক চার্জ পতিত হয়।
সূত্র: মোহাম্মদ আব্দুল কাদের, প্রভাষক, ইইই, আইইউসি।