১। ইংরেজী ভাষায় “স্বর্ণ” এর ইংরেজী Gold। Gold শব্দটি এসেছে প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয়ান মূল *ghel বা *ghol থেকে, যার অর্থ “হলুদ” (yellow), “সবুজ” (green) বা সম্ভবত “উজ্জ্বল” (bright) থেকে।
২। স্বর্ণ পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশেই পাওয়া যায়।
৩। স্বর্ণের গলনাঙ্ক ১০৬৪.৪৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এটা তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী এবং কখনও মরিচা পড়ে না।
৪। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফ্রান্সে পরিচালিত এক চিকিৎসা জরিপে দেখা যায় যে, গেটে বাতের (rheumatoid arthritis) চিকিৎসায় স্বর্ণ খুব কার্যকরী।
৫। সুদূর অতীত থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছে উচ্চ মূল্যের কারণে সেগুলো এখনও মানুষের হাতে হাতে ঘুরে-ফিরে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু, ধারণা করা হয়, পৃথিবীর ৮০% স্বর্ণ এখনও মাটির নীচে রয়েছে।
৬। ১৯১০ সাল থেকে যত স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছে তার ৭৫% স্বর্ণ মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে।
৭। “Welcome Stranger” হচ্ছে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় স্বর্ণের টুকরা। জন ডিসন (John Deason) এবং রিচার্ড অটস (Richard Oates) ১৮৬৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারীতে অষ্ট্রেলিয়ায় এটি খুঁজে পান। ১০ বাই ২৫ ইঞ্চি আয়তনের টুকরাটির ওজন ছিল ২২৪৮ আউন্স বা ৬৩ কেজি! একেবারে খাঁটি স্বর্ণ!! খুঁজে পাওয়ার সময় এটি মাটির মাত্র ২ ইঞ্চি নিচে লুক্কায়িত ছিল।
৮। স্বর্ণ নমনীয় হওয়ার এটি থেকে সুতা তৈরী করা যায়। এক আউন্স স্বর্ণকে টেনে ৫০ মাইল লম্বা করা যায়!

৯। ২০০৮ সালের মার্চ মাসে অর্থনৈতিক মন্দা হওয়ার গুজবে ইতিহাসে প্রথম বারের মত স্বর্ণের দাম আউন্স প্রতি ১০০০ মার্কিন ডলারে উঠেছিল।
১০। অর্থনীতিতে টানা-পোড়েন দেখা দিলে বরাবরের মত চল অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা মূল্যবান ধাতু যেমন, স্বর্ণ বা রূপা কিনে মজুত করে থাকেন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল তাদের রিপোর্টে প্রকাশ করেছিল যে, ২০০৮ সালের শেষ মধ্যবর্তী সময় থেকে স্বর্ণের চাহিদা দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল।
১১। যুক্তরাষ্ট্রে ডাউ/গোল্ড (Dow/Gold) অনুপাতের মাধ্যমে বুঝা যায় ডাউ এর একটা শেয়ার কিনতে কতগুলো গোল্ড লাগবে; আবার এই অনুপাতটি নির্দেশ করে থাকে অর্থনৈতিক মন্দার ভয়াবহতা কি পর্যায়ে আছে। ২০০৯ সালের প্রথম দিকে ডাউ/গোল্ডের নিম্নমুখী অনুপাত ১৯৩০ ও ১৯৮০ সালের মত নিম্নমুখী অনুপাতের মত ছিল।
১২। রাসায়নিকভাবে স্বর্ণ একটি নিষ্ক্রিয় পদার্থ। এ জন্য, এতে মরিচা পড়ে না এবং মানবদেহে কোন চুলকানির (irritation) সৃষ্টি করে না। স্বর্ণালঙ্কার পড়ে যদি চুলকানির সৃষ্টি হয়, তবে ধরেই নেয়া যায় ঐ স্বর্ণে খাদ মেশানো হয়েছে।
১৩। এক ঘনফুট স্বর্ণের ওজন অর্ধ টন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বর্ণের বারের ওজন ২০০ কেজি বা ৪৪০ পাউন্ড।
১৪। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রিক মুনারিজ খোঁজ নিয়ে দেখলেন শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করার করার জন্য কোনটি ভাল খাত হতে পারে, গুগল নাকি স্বর্ণ; ঐ সময়ে দু’টিরই বলতে গেলে একই মূল্যমান ছিল। ২০০৮ সালের দিকে গুগলের শেয়ারের দাম উঠল ৩০৭.৬৫ মার্কিন ডলার, কিন্তু বছরান্তে স্বর্ণের দাম ক্লোজ হয়েছিল ৮৬৬ ডলারে।
১৫। ওলিম্পিক গেমসে, ১৯১২ সালে যে মেডালগুলো প্রদান করা হয়েছিল, তা খাঁটি স্বর্ণের তৈরী ছিল। বর্তমানে যে মেডালগুলো দেয়া হয়, তাতে ছয় গ্রাম স্বর্ণের প্রলেপ দিয়ে মোড়ানো হয়।
১৬। প্রাচীন ইনকা’রা মনে করত, তাদের পরম পূজনীয় সূর্য দেবতার অবতার হচ্ছে স্বর্ণ এবং তারা এই মূল্যবান ধাতুকে “সূর্যের কান্না” হিসাবে আখ্যা দিত। কারণ, সে সময় স্বর্ণ কেউ টাকা দিয়ে ক্রয় করত না; স্বর্ণের প্রতি ইনকা’দের অনুরাগের উৎস ছিল তাদের আভিজাত্য ও ধর্মীয় প্রেরণা থেকে।
১৭। স্বর্ণ এতটাই দূষ্প্রাপ্য যে, এক ঘণ্টাতে যে পরিমাণ ইস্পাত তৈরী হয় পৃথিবী লিখিত ইতিহাসে জ্ঞাত পরিশুদ্ধ করা এত স্বর্ণ তৈরী হয় নাই।

১৮। খ্রিস্ট জন্মের ১২০০ বছর আগে মিশরীয়রা কৃষ্ণ সাগরের বালু থেকে পশমযুক্ত ভেড়ার চামড়া দিয়ে স্বর্ণ আহরণ করত। এই রীতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরী হয়েছে “Golden Fleece”।
১৯। প্রাচীন টুরিন প্যাপিরাস (Turin Papyrus) স্ক্রিপ্টে নুবিয়া (Nubia) তে অবস্থিত প্রাচীন আমলের প্রথম স্বর্ণের খনির মানচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কি, প্রাচীন মিসরীয়রা স্বর্ণকে “নুব” বলত; আর এই শব্দটি এসেছে স্বর্ণের জন্য বিখ্যাত শহর “নুবিয়া” থেকে। মিসরীয় স্বর্ণের খনিগুলোতে কর্মরত দাসরা অত্যন্ত অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করত, কিন্তু, সেখানকার ধনিক শ্রেণীর জন্য স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুতকারকেরা একেবারে ধর্মযাজকদের মত উঁচু মর্যাদায় বসবাস করত।
২০। মূসা (আ.) যখন সিনাই পাহাড়ে আল্লাহ তায়া’লার সাথে কথা বলতে গেলেন, তখন তার অনুসারীদের কাছে এত স্বর্ণ ছিল, তারা ঐ স্বর্ণ দিয়ে একটি বাছুর তৈরী করে এবং তার চতুর্দিকে পূজাৎসব করা শুরু করে দিয়েছিল। ধর্ম বিশারিদগণ ধারণা করছেন যে, ইহুদীদের অবাধ্যতার কারণে সৃষ্টিকর্তার শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য স্বর্ণ বিনিময় স্বরূপ দেয়ার চিন্তা তারা করতে পারে নাই; কারণ ঐ একটাই; তখন স্বর্ণের কোন বিনিময় মূল্য ছিল না।
২১। বাইবেলে অন্তত ৪০০ স্তবকে স্বর্ণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; এমনকি খাঁটি স্বর্ণ দিয়ে “টাবারনাকল” (Tabernacle) এর সকল আসবাবপত্রগুলো ঢেকে রাখার জন্য ঈশ্বরের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়াও, “মেজাই” (Magi) দের উপহার সামগ্রীর মধ্যে স্বর্ণের উল্লেখ রয়েছে।
২২। প্রাচীন গ্রীকরা মনে করত, পানি ও সূর্যালোকের সংমিশ্রন থেকে স্বর্ণ তৈরী হয়েছে।
২৩। ক্যারেট ওজন (caret weight) এর মান ১০, ১২, ১৪, ১৮, ২২, এবং ২৪ হতে পারে। এর মান যত বেশী, বিশুদ্ধতাও তত বেশী। “সলিড গোল্ড” (solid gold) হতে হলে এর ন্যূনতম বিশুদ্ধতা হতে হবে ১০ ক্যারেট। “পিওর গোল্ড” (pure gold) হতে হলে এর
ক্যারেট ওজন হতে হবে ন্যূনপক্ষে ২৪। “পিওর গোল্ডের” মধ্যে স্বর্ণের দৃঢ়তার জন্য সামান্য মাত্রায় কপার দিতে হয়। অবাক করা ব্যাপার হল “পিওর গোল্ড” এত নমনীয় যে, একে খালি হাতে বাঁকানো বা চটকানো যায়।
২৪। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ সালে লিন্ডিয়ানরা (Lyndian) প্রথম গোল্ড কয়েন চালু করে; প্রাকৃতিকভাবে তৈরী হওয়া স্বর্ণ ও রৌপ্যের মিশ্রন থেকে তৈরী হওয়া ধাতু, যার নাম “ইলেকট্রাম” (electrum) থেকে এগুলো তৈরী হত।
[adinserter block=”1″]
লিন্ডিয়ানদের বস্তুগত আসক্তিকে তিরস্কার করেছিলেন হিরোডোটাস, যিনি আবার সর্বপ্রথম চালু করেন “স্থায়ী খুঁচরা পণ্য বিক্রির দোকান”।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৬ সালে পারসিকদের হাতে লিন্ডিয়ানরা বন্দী হলে তাদের কাছে থেকে স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।
২৫। স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন হওয়ার পূর্বে, তখনকার সময়ে বিভিন্ন ধরণের পশু, বিশেষ করে গৃহপালিত পশু এবং উদ্ভিজ্জ পণ্যগুলোকে বিনিময় মুদ্রা হিসাবে ব্যবহৃত হত।
উপরন্তু, মুদ্রা সহজলভ্য না হওয়াতে রাষ্ট্রীয় নির্মাণ কাজগুলোতে দাসদের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেয়া হত।
২৬। গল’রা (Gaul) যখন রোমানদের অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখার মন্দিরে হামলা চালায়, তখন রাজহাসদের চিৎকারে রোমানরা সতর্ক হয়ে যায়। আর এতে কৃতজ্ঞ রোমানবাসীগণ তাদের “সতর্ক করার দেবী”, মোনেটা (Moneta) এর স্মরণে একটি তীর্থস্থান নির্মাণ করে। রক্ষা পাওয়া ধন-সম্পদ এবং মোনেটা যোগসূত্র থেকে বহু শতাব্দী পরে ইংরেজী শব্দের অভিধানে “মানি” (money) এবং “মিন্ট” (mint) শব্দ দু’টি যুক্ত হয়েছিল।
২৭। ৩০৭ এবং ৩২৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রোমে এক পাউন্ড স্বর্ণের মূল্য ১০০,০০০ “দেনারি” (denarii (রোমান মুদ্রা) থেকে ৩০০,০০০ দেনারিতে চড়ে যায়। রোমানদের দুঃখ এখানেই শেষ নয়। আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতির কারণে এক সময় পুরো রোমান সামাজ্যের পতন ঘটে। চতুর্থ শতাব্দীর দিকে রোমে পাউন্ড প্রতি স্বর্ণের মূল্য দাঁড়িয়েছিল ২১ লক্ষ ২০ হাজার দেনারিতে।
২৮। স্বর্ণের রাসায়নিক সংকেত Au; এসেছে ল্যাটিন শব্দ Aurum থেকে, যার অর্থ “সূর্যস্নাত ভোর” (shining dawn) এবং Aurora থেকে, রোমান ভাষায় যার অর্থ “ভোরের দেবী”। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০ সালে, রোমানরা দুইটী সাইজের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন শুরু করে, বড়টির নাম Aureus এবং ছোটটির নাম solidus।

২৯। স্বর্ণের বিশুদ্ধতা মাপার নিরীক্ষা পদ্ধতির নাম “পিক্স” (Pyx) ১২৮২ সালে ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছিল; সেই থেকে তা এখনও চালু আছে। “পিক্স” শব্দটি এসেছে গ্রীকদের ব্যবহৃত “কাঠের তৈরী বাক্স” থেকে যাতে করে পরীক্ষকদের কাছে কয়েনের বিশুদ্ধতা মাপার জন্য পাঠান হত। বর্তমানে কয়েনের তিনটি দিকের সঠিকতা পরিমাপ করা হয়, পরিধি, রাসায়নিক কম্পোজিশন এবং ওজন।
৩০। চৌদ্দশ’ শতাব্দীর দিকে বিউবোনিক প্লেগের (মহামারী) চিকিৎসায় গলিত স্বর্ণ ও খনিজ চূর্ণ করে খাওয়ানো হত।
৩১। ১৫১১ সালে স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ কয়েনের উপরে খোদাই করেন সেই বিখ্যাত উক্তিটি: “Get gold, humanely if possible—but at all hazards, get gold.”
৩২। ১৫৯৯ সালে ইকুয়েডর শাসনকারী স্প্যানিস গভর্নর ইকুয়েডরের অধিবাসী জিভারোদের (Jivaro) উপরে সাধ্যাতিরিক্ত ট্যাক্স চাপিয়ে দিয়েছিল। এ কারণে জিভারোরা তাকে ধরে তার গলার মধ্যে গলিত স্বর্ণ ঢেলে দেয়। স্প্যানিস এবং রোমানরা বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এই ধরণের পদ্ধতি অবলম্বন করত।
৩৩। ভেনিসরা ১২৮৪ সালে এক ধরণের স্বর্ণ মুদ্রার (ducat) প্রচলন করে। এই মুদ্রা বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৫০০ বছর ধরে জনপ্রিয় ছিল। এই ডুকাট শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ “ডিউক” (duke) থেকে। শেকসপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি উপন্যাস “Romeo and Juliet” এই স্বর্ণ মুদ্রা ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে এবং “The Merchant of Venice” এ মুদ্রার উল্লেখ রয়েছে।
ডুকাট’র নাম এসেছে র্যাপার গায়ক আইস কিউব এর গানের কলিতে। তার “I Ain’t the One” গানের তিনি গেয়েছেন, “he’s getting juiced for his ducats”।
আবার, “Babylon 5” চলচ্চিত্র সিরিজে সেন্টারি রেসের বাজির অর্থের মুদ্রার নামও ছিল ডুকাট।
৩৪। যুক্তরাষ্ট্রের টাকশালে এক সময় ২.৫ ডলার, ১০ ডলার এবং ১৫ ডলারের কয়েন তৈরী হত। ১৯৩৩ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় এই স্বর্ণ মুদ্রা তৈরী বন্ধ করে দেয়া হয়।
৩৫। স্বর্ণ খাওয়া যায়! এশিয়ার কিছু দেশে ফল, জেলি স্ন্যাক্স, কফি, এবং চা এ স্বর্ণ ব্যবহার করা হত। অন্তত ১৫০০ শতক পর্যন্ত, ইউরোপের কিছু কিছু দেশে পানীয় বোতল, যেমনঃ ডানজিগার গোল্ডওয়াসার এবং গোল্ডসল্যাগার এ স্বর্ণ প্রলেপ দেয়া পাতা ব্যবহার করা হত। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী বিশ্বাস করত যে, স্বর্ণ খেলে বাতাসে ভেসে থাকা যায়।

৩৬। যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার ফুটবল টিমের নামকরণ করা হয়েছে ১৮৪৯ সালের স্বর্ণের খনি খননকারীদের স্মরণে।
৩৭। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছরের দিকে মানুষ স্বর্ণ ও কপার আবিষ্কার করে এবং এ দু’টো ধাতুর রঙই সাদা নয় (non-white)।
৩৮। পৃথিবীতে অনেক ধরণের মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণকে ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র তৈরী করে “ব্রিটন উডস সিস্টেম” (Bretton Woods System) যা ডলারের মুল্য নির্ধারণ করে একটা ট্রয় আউন্সের (888.671 mg) ৩৫ ভাগের এক ভাগ। এই সিস্টেমকে ১৯৭১ সালে বাতিল করে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যত কাগজের মুদ্রা ছিল সেগুলোর বিপরীতে পর্যাপ্ত স্বর্ণের মুদ্রা না থাকাতে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
৩৯। নিউইয়র্কে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ভূগর্ভস্থ পাঁচ তলা ভল্টে থরে থরে সাজানো রয়েছে পৃথিবী সর্ববৃহৎ স্বর্ণের মজুত। এতে রয়েছে ৫,৪০,০০০ স্বর্ণের বার যা পৃথিবীর মোট স্বর্ণের মজুতের ২৫% এর সমান। স্বর্ণের এই মজুত ফোর্ট নক্স (Fort Knox) এর স্বর্ণের মজুতের চেয়েও বেশী। এর স্বর্ণের বেশীর ভাগই ভিন দেশী সরকারের।
৪০। স্বর্ণের পরিমাপকের একক “ট্রয় আউন্স” শব্দটি এসেছে ফ্রান্সের শহর ট্রয়েস (Troyes) থেকে। মধ্য যুগীয় সময়ে মূল্যবান ধাতু ও হীরা-জহরতের পরিমাপের একটি একক সর্বপ্রথম তৈরী করা হয় এখানে। ৪৮০ গ্রেইনের হয় এক ট্রয় আউন্স। একেবারে ৬৪.৭৯৮৯২ মিলিগ্রামে হয় এক গ্রেইন।
৪১। আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০ বছর থেকে গ্রিক ও ইহুদীরা আল-কেমি (রসায়ন) নিয়ে গবেষণা করা শুরু করে। তাদের সকলেরই তপসা ছিল, কিভাবে ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করা যায়। মধ্য যুগ ও রেনেসা যুগে এই তপসা চরম উন্মাদনায় পরিণত হয়।

৪২। বেশির ভাগ দেশের সরকার কর্তৃক স্বর্ণের স্ট্যান্ডার্ডের ক্ষেত্রে ফিয়াট (fiat – Latin for “let it be done”)) স্ট্যান্ডার্ড গ্রহন করে। টমাস জেফারসন এবং এ্যান্ড্রু জ্যাকসন – উভয়ই ফিয়াট স্ট্যান্ডার্ডের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। অনেক সমকালীন অর্থনীতিবিদগণ যুক্তি দিয়ে বলেন, ফিয়াট মুদ্রা নীতির ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ঘন ঘন সংকোচন ও সম্প্রাসারণের মাত্রা সৃষ্টি হয় এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়।
৪৩। সাউথ আফ্রিকার খনিগুলোর গভীরতা অনেক সময় ১২,০০০ ফুট পর্যন্ত গভীর এবং এর মধ্যে তাপমাত্রা ১৩০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক আউন্স স্বর্ণ উত্তোলন করতে এক জন ব্যক্তির ৩৮ ঘণ্টা শ্রম দিতে হয়, প্রয়োজন হয় ১৪০০ গ্যালন পানি, যে বিদ্যুৎ খরচ হয় তা দিয়ে একটি বিশাল বাড়ির ১০ দিন আলোকিত করা যায়; প্রয়োজন হয় সায়ানাইড, এসিড, শিশা, বোরাক্স এবং চুনের মত কেমিকেলসমূহ। হিসাব করে দেখা গেছে, সাউথ আফ্রিকায় ৫০০ টন স্বর্ণ উৎপাদনের জন্য বছরে ৭০ মিলিয়ন টন মাটি উত্তোলন করে তা মেশিন দ্বারা প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে হয়।
৪৪। জ্ঞাত ইতিহাসে এ পর্যন্ত আনুমানিক ১৪২,০০০ টন স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছে। স্বর্ণের দাম আউন্স প্রতি ১,০০০ ডলার ধরে হিসাব করলে এ পর্যন্ত যত স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছে তার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই প্রচিলিত বা মজুত রয়েছে ৭.৬ ট্রিলিয়ন মুল্যমানের স্বর্ণ যা থেকে বোঝা যায় যে, আগে প্রচলিত গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণও একই অভিমত পোষণ করলেও এর বিকল্প হিসাবে কিছু গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের কথা তারা বলছেন; এর যে কোন গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডে ফিরে গেলে মূল্যস্ফীতি কমবে এবং অর্থব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবে।
৪৫। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার কাবারাস এ প্রথম আবিষ্কৃত স্বর্ণ খণ্ডের ওজন ছিল ১৭ পাউন্ড। এরপর ১৮০৩ সালে একে একে লিটল মিডো ক্রিক, নর্থ ক্যারোলিনা’র বিভিন্ন স্থানে স্বর্ণ খুঁজে পাওয়া খবর ছড়িয়ে পরলে যুক্তরাষ্ট্রের এসব জায়গার মানুষেরা দলে দলে স্বর্ণ শিকারে বেরিয়ে পরে।
৪৬। ১৮৪৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া’র স্যাক্রামেন্টো’তে জন সাটার দূর্গের জন্য কাটের মিল নির্মাণের সময় জন মার্শাল নামক এক ভদ্রলোক স্বর্ণের টুকরা খুঁজে পান।
এই আবিষ্কারের পর ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশ ছড়িয়ে পড়ে এবং আমেরিকান নীতিহীন ওয়েস্ট ব্যবস্থার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সাহায্য করে।
৪৭। প্রাচীন মিশরে স্বর্ণকে বিধাতা, বিশেষ করে মিশরের সূর্য দেবতা, “রা” এর চামড়া বলে মনে করা হত। এর ফলে, স্বর্ণ এক সময় ফারাও বাদশাদের অধিকারে চলে যায়, পরবর্তীকে ধর্মযাজক ও রাজকীয় বিচারক সদস্যদের ব্যবহারের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়। বাদশাদের মরদেহ যে চেম্বারে রাখা হত সেটিকে “স্বর্ণের বাড়ি” হিসাবে পরিচিত ছিল।
৪৮। ১৯৩৩ সালে ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট ৬১০২ নম্বর নির্বাহী আদেশে দস্তখতের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বর্ণ মজুদের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। জুয়েলার, ডেন্টিস্ট, ইলেকট্রিশিয়ান, এবং অন্যান্য শিল্প ইন্ডাস্ট্রির কাজ ব্যতীত অন্য কেহ স্বর্ণ মজুদ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হত। আর, এই অপরাধের জন্য ১০,০০০ মার্কিন ডলার জরিমানা ও দশ বছর কারাভোগের শাস্তি রাখা হয়েছিল।

৪৯। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েসে অ্যামারশাম কর্পোরেশনে গবেষণায় স্বর্ণের গোলক ব্যবহার করে মানবদেহের বিশেষ কিছু প্রোটিনকে চিহ্নিত করে তাদের কাজের ধারা খুঁজে বের করা হয়। এই প্রক্রিয়া রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনে সহায়তা করে।
৫০। স্বর্ণের বিশুদ্ধতার পরিমাপ হল “ক্যারেট ওয়েট”। ক্যারেট শব্দটি এসেছে “কারোব সিড” থেকে যা মধ্যপ্রাচ্যে অল্প পরিমাণের কোন কিছুকে পরিমাপের জন্য ব্যবহারের একক হিসাবে ব্যবহৃত হত। আর, এই ক্যারেট পাওয়া যেত কারোব গাছের বিচি থেকে। প্রতি বিচির ওজন ছিল এক গ্রামের পাঁচ ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ ২০০ মিলিগ্রাম।