সঠিক নিয়মে নিয়মিত রক্ত দেওয়া হলে তা শরীরের জন্য উপকার বয়ে আনে। অপারেশন বা আঘাতের কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণের পরে ডোনারের দেওয়া রক্ত রোগীর শরীরে দেওয়া হয়। এ সময় পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন।
রক্ত দেওয়ার অনেক ভাল দিক থাকলেও, রক্ত দেয়ার আগে ও পরে রক্তদাতাকে বেশ কিছু ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। জেনে নিন রেডক্রস ব্লাড ডট অর্গের ওয়েবসাইটে দেয়া এ সংক্রান্ত বেশকিছু নির্দেশনা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে পোস্ট আকারে তুলে ধরা হল।
রক্ত দেয়ার আগে যা করবেন
১. রক্ত দেয়ার আগে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে নিন কিন্তু তৈলাক্ত কিছু খাবেন না। রক্ত দানের আগে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে।
২. যেদিন রক্ত দেবেন তার আগের রাতে অনেকটা সময় ভালো করে ঘুমিয়ে নেবেন।
৩. রক্ত দেয়ার দুইদিনের মধ্যে মাথা ব্যথার কোনও ওষুধ খাবেন না।
৪. এমন একটি শার্ট পড়ুন যেটার হাতা কনুইয়ের উপর ওঠানো যায়। সবচেয়ে ভালো হয় টি-শার্ট পড়লে।
৫. রক্ত দেয়ার সময় কোনও চাপ অনুভব করা যাবে না। গান শুনতে পারেন অথবা আপনার আশেপাশে থাকা অন্যান্য ডোনারদের সাথে কথা বলতে পারেন।
রক্ত দেয়ার পরে যা করবেন
১. যেদিন রক্ত দেবেন ওইদিন ভারী কোনও জিনিস বহন করবেন না।
২. রক্ত দেয়ার পর চার গ্লাস পানি খান এবং পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় গ্রহণ করবেন না।
৩. আপনার হাতের যে জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগানো থাকে ওইটা অন্তত কয়েক ঘণ্টা রাখুন। ব্যান্ডেজ খুলে সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে পারেন। নইলে চুলকানি হতে পারে।
৪. রক্ত দেয়ার পরপর হঠাৎ করে দাঁড়ালে অনেকের মাথা ঘোরাতে পারে এবং দুর্বল লাগতে পারে। এরকম হলে একটু শুয়ে থাকুন। একটু ভালো বোধ করলেই আবার উঠে দাঁড়ান।
৫. আয়রন, ফোলাইট, রিবোফ্লাবিন, ভিটামিন বি৬ সমৃদ্ধ খাবার যেমন লাল মাংস, মাছ, ডিম, কিশমিশ, কলা ইত্যাদি খাবার বেশি করে খাবেন। এসব খাবার আপনার রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।
৬. প্রচুর পরিমাণে পানি ও পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করুন। এই ব্যাপারে মোটেও অবহেলা করবেন না।
৭. কয়েক ঘণ্টার জন্য শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করা থেকে বিরত থাকুন এবং বেশ কিছুদিন সাধারণ সময়ের তুলনায় একটু কম পরিশ্রম করে বিশ্রাম নিন।
৮. রক্তদানের তিন মাস পর নতুন করে রক্ত দিতে পারবেন। এর আগে কোনোভাবেই পুনরায় রক্ত দেবেন না।
কারা রক্ত দিতে পারবেন
- প্রাপ্ত বয়স্ক যেকোন সুস্থ মানুষ অন্যকে রক্ত দিতে পারে। তবে বয়স ও শরীরের ওজনকে বিবেচনা করতে হবে।
- উপযুক্ত বয়স- মহিলা ও পুরুষ যাদের বয়স ১৮ – ৪৫ বছর।
- উপযুক্ত ওজন- পুরুষদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ৪৭ কেজি বা তার উর্ধে হতে হবে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪৫ কেজি বা তার উর্ধে হতে হবে।
যারা রক্ত দিবেন না
- যাদের ৩ বছরের মধ্যে জন্ডিস হয়েছে
- যাদের রক্ত বাহিত জটিল রোগ রয়েছে
- ৪ মাসের মধ্যে যারা রক্ত দিয়েছেন
- যারা ৬ মাসের মধ্যে বড় কোন অস্ত্রপচার করিয়েছেন
- মহিলাদের ক্ষেত্রে যারা গর্ভবতী অথবা যাদের মাসিক বা ঋতুস্রাব চলছে
এসব বিষয় ছাড়াও রক্ত দেয়ার সময় রক্তদাতার অন্যান্য শারীরিক বিষয় যাচাই করা হয়।
রক্তদানের সাধারন তথ্য
- এক ব্যাগ রক্ত দিলে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না।
- রক্ত দানের ৫- ২১ দিনের মধ্যে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।
- রক্ত দিলে হাড়ের বোনম্যারোতে নতুন রক্ত কণিকা তৈরিতে উদ্দীপনা আসে।
- ব্যবহৃত সূচ সিরিঞ্জ জীবাণু মুক্ত কি না জেনে নিন।
- খালি পেটে রক্ত দিবেন না।
- রক্তদানের পুর্বে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জেনে নিন।
- পরিচিত ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে রক্ত দিন।
রক্তের গ্রুপসমূহ ও আন্ত:গ্রুপের মধ্যে সম্পর্ক
নিচের সারণী থেকে আমরা দেখে নিতে পারি কোন গ্রুপের রক্ত কাকে দিতে পারবে বা কার কাছ থেকে রক্ত নিতে পারে:

কোন ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়ার সময় সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মে রক্তের গ্রুপ ও আরএইচ (Rh) মিলিয়ে দেখা হয়। এই দু’টি শর্ত না মিললে রক্ত দেওয়া যায় না।
- আরএইচ-নেগেটিভ রক্ত শুধুমাত্র আরএইচ-নেগেটিভ রক্ত গ্রহিতাকে দেওয়া যায়।
- আরএইচ-পজিটিভি বা আরএইচ-নেগেটিভ রক্ত আরএইচ-পজিটিভি রক্ত গ্রহিতাকে দেওয়া যায়।
রক্তের প্লাজমা দেওয়ার বেলায় আবার নিয়ম ঠিক তার উল্টা। যেমন:
- ও-নেগেটিভ রক্ত যার রয়েছে, তিনি সব গ্রুপের গ্রহীতাকেই রক্ত দিতে পারবেন।
- প্লাজমার বেলায়, এবি গ্রুপ রক্তের প্লাজমা ডোনার অন্যান্য সকল গ্রুপের প্লাজমা গ্রহীতাকে দান করতে পারবে।
ঢাকার কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকের ঠিকানা ও ফোন নম্বর
ব্লাড প্রোগ্রাম, বাংলাদেশে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
৭/৫ আওরাঙ্গজেব রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
ফোন : ০২-৯১৩৯৯৪০।
ওয়েবসাইট: www.bdrcs.org
২৪ ঘন্টা খোলা
সার্বিক খরচ: ৭০০ টাকা
পুলিশ ব্লাড ব্যাংক
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, রাজারবাগ।
ফোন : ০২-৯৩৬২৫৭৩।
মোবাইল : ০১৭১৩-৩৯৮৩৮৬।
ই-মেইল : info@policebloodbank.gov.bd
ওয়েবসাইট : www.policebloodbank.gov.bd
সার্বিক খরচ: ৪০০ টাকা
কোয়ান্টাম সেন্টার
৩১/ডি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সড়ক (পুরাতন শান্তিনগর) ঢাকা-১২১৭। (ইস্টার্ন প্লাস মার্কেটের পূর্ব পাশে)
ফোন : ০২-৮৩২২৯৮৭।
মোবাইল : ০১৭১৪-০১০৮৬৯।
ই-মেইল : blood@quantammethod.org.bd
ওয়েবসাইট : www.quantammethod.org.bd
২৪ ঘন্টা খোলা
সার্বিক খরচ: ৭৫০ টাকা
বাঁধন ব্লাড ব্যাংক
বাঁধন, টি.এস.সি (নীচতলা) (জোনাল অফিস) ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ল
ফোন: ০২-৮৬২৯০৪২
মোবাইল: ০১৫৩৪-৯৮২৬৭৪।
ওয়েবসাইট: www.badhan.org
ই-মেইল : du@badhan.org
সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা
রক্ত দিতে করতে কতক্ষণ সময় লাগে?
রক্তদাতার রক্তের স্যাম্পল নিয়ে বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা করতে সময় লাগে প্রায় ৫০ মিনিট। রিপোর্টে সব কিছু ঠিক থাকলে, ১ ব্যাগ রক্ত দিয়ে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট। সব মিলিয়ে ১ ঘন্টাতে রক্তদানের কার্যক্রম শেষ করতে পারবেন।
রোজা অবস্থায় রক্ত দান করলে কি রোজা ভেঙ্গে যায়?
রোযা অবস্থায় রক্ত দিলে রোযা ভাঙ্গে না। তাই টেস্ট বা পরীক্ষার জন্য রক্ত দেওয়া যাবে। তবে, স্মরণে রাখতে হবে, এমন ভাবে রক্ত দেয়া যাবে না, যে কারণে শরীর দূর্বল হয়ে পরে এবং সিয়াম রাখা কষ্টকর হয়ে যায়। এভাবে রক্ত দেয়া মাকরুহ।
তবে, সবল ব্যক্তি, যিনি রক্ত দিয়ে ভেঙ্গে পরবেন না, তার ক্ষেত্রে রক্ত দানে কোন অসুবিধা নাই।
সূত্র: সহিহ বুখারি, হাদিস ১৯৩৬, ১৯৪০, আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৩; কিতাবুল আসল ২/১৬৮; মাজমাউল আনহুর ১/৩৬০।
রক্ত দেওয়া নিয়ে কিছু FAQ
- ক্যানসার, হৃদরোগ, বাতজ্বর, সিফিলিস (যৌন রোগ), কুষ্ঠ বা শ্বেতী রোগীরা রক্ত দিতে পারবেন কিনা?
উত্তর: কখনও রক্ত দিতে পারবেন না। - হাঁপানি রোগীর ইনহেলার ও নিয়মিত ঔষধ সেবন করলে রক্ত দেয়া যাবে কিনা?
উত্তর: না - এন্টিবায়োটিক ঔষধের কোর্স চলাকালীন সময়ে রক্ত দেয়া যাবে কিনা?
উত্তর: শেষবার সেবনের কমপক্ষে ১ সপ্তাহ পর রক্ত দেয়া যাবে। - সর্দি-জ্বর অথবা কোন ভাইরাস জনিত রোগে আক্রান্ত অবস্থায় রক্ত দেয়া যাবে কিনা?
উত্তর: সুস্থ হওয়ার কমপক্ষে ৭ দিন পর দেয়া যাবে। - কোন প্রকার টিকা গ্রহণ করার কতদিন পরে রক্ত দেয়া যাবে?
উত্তর: ২৮ দিন। - যক্ষ্মা হলে পূর্ণমাত্রার ওষুধ সেবনের কতদিন পর রক্ত দেওয়া যাবে?
উত্তর: ২ বছর - হেপাটাইটিস ‘এ’ / হেপাটাইটিস ‘ই’ থেকে সুস্থ হওয়ার কত মাস পর রক্ত দেওয়া যাবে?
উত্তর: ৬ মাস - হেপাটাইটিস বি / সি আক্রান্তরা কি রক্ত দিতে পারবেন?
উত্তর: কখনই রক্ত দিতে পারবেন পারবেন না। - জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া অবস্থায় রক্ত দেয়া যায় কিনা?
উত্তর: রক্ত দেওয়া যাবে। - গর্ভাবস্থায় রক্ত দেয়া যাবে কিনা?
উত্তর: না। - মেয়েলি সমস্যা চলাকালিন রক্ত দেয়া যাবে কিনা?
উত্তর: না। - রক্তদানের কতদিন পর পুনরায় রক্তদান করা যায়?
উত্তর: পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩ মাস অন্তর-অন্তর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৪ মাস অন্তর-অন্তর।
ফেসবুকের মাধ্যমে রক্তদাতা হিসাবে নিবন্ধনকরণ
অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও ফেসবুকের মাধ্যমে রক্ত দাতা হিসাবে নিবন্ধিত হওয়া যায়। ২৩ জানুয়ারী, ২০১৮ (মঙ্গলবার) থেকে বাংলাদেশে এই ফিচার চালু করেছে ফেইসবুক।
রক্তদাতা হিসেবে সাইন–আপ করতে গ্রাহকের ফেইসবুক প্রোফাইলটি এডিট করে নিতে হবে বা ভিজিট করতে হবে facebook.com/donateblood লিংকে। রক্তদাতাদের অংশগ্রহণে আগ্রহী করতে তাদের নিউজ ফিডে একটি বার্তা দেখানো হবে। ‘অনলি মি’ অপশনটি বাছাই করে গ্রাহক তার সব তথ্য গোপন রাখতে পারবেন। আবার, চাইলে রক্তদানের পরিসংখ্যান সবার সঙ্গে শেয়ারও করতে পারবেন। অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস এবং পিসি ব্যবহারকারীরা এই ফিচারটি উপভোগ করতে পারবেন।
সাধারণ মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া এবং পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ সাধারণ মানুষ, ব্লাড ব্যাংক ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আরও সহজে ফেইসবুকের রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। যখন কোনো ব্যক্তি রক্তের সন্ধান করবেন তখন তিনি ফেইসবুকে বিশেষ পোস্ট তৈরি করে সবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেইসবুক থেকে একটি নোটিফিকেশন কাছাকাছি থাকা রক্তদাতার কাছে পৌঁছে যাবে। রক্তদাতা পোস্টটি দেখার পর যদি রক্তদানে আগ্রহী থাকেন তাহলে তিনি সরাসরি অনুরোধকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত রক্তদাতা স্বেচ্ছায় তার সম্পর্কিত তথ্য অনুরোধকারীর সঙ্গে শেয়ার না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত অনুরোধকারী রক্তদাতার সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারবেন না।