ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল যে তিনি সত্যের ধার ধারেন না, নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, হোয়াইট হাউসে পূর্বসূরিদের অনেকেই অবিশ্বাস্য মাত্রায় মিথ্যাচার করে গেছেন, তুল্যমূল্যে ট্রাম্প যেখানে দুগ্ধপোষ্য শিশুমাত্র।
বিবিসির প্রতিবেদনে প্রকাশ, সাদ্দাম হোসেন যখন ১৯৯০ সালের আগস্টে কুয়েত দখল করেন, তখন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ বলেন, এটা সহ্য করা হবে না! নিজের সহকারীর বিজ্ঞাপন কোম্পানি হিল-এন্ড-নোলটনের মাধ্যমে বুশ যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে প্রচারণা শুরু করেন। ‘নাইরা‘ নামে ১৫ বছরের এক কিশোরীকে ইরাকি আগ্রাসনের ‘প্রত্যক্ষদর্শী শিকার’ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ওই কিশোরী ছলছল চোখে কাঁদো কাঁদো গলায় মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সামনে দাঁড়িয়ে জানায়, কীভাবে ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতের একটি হাসপাতালে ঢুকে ইনকিউবেটর থেকে সদ্যোজাত অসুস্থ শিশুদের বের করে তাদের মেঝেতে শুইয়ে রাখে, যাতে তারা মারা যায়।
যুদ্ধের পর জানা যায়, ওই কিশোরী ছিল যুক্তরাষ্ট্রে কুয়েতি রাষ্ট্রদূতের মেয়ে এবং সে যা বলেছিল, সেটি ছিল পুরোটাই মনগড়া।
প্রথম গালফ ওয়ার নিয়ে এক বইতে জন ম্যাকআর্থার ওই ঘটনার বিস্তারিত তুলে আনেন।
সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অজুহাত হিসেবে সিনিয়র বুশ রাষ্ট্রদূতের বয়ান করা ওই ‘কল্পকাহিনী’ জনসমক্ষে তুলে ধরেন। পরে জানা যায়, হাসপাতালের ইনকিউবেটর থেকে সরানোর জন্য সত্যিই শিশুদের মৃত্যু ঘটেছিল ওই হাসপাতালে, তবে তা করতে হয়েছিল সেখানে মার্কিন বিমান হামলার পরিণতিতে। ওই ঘটনায় ৪০টি সদ্যোজাত শিশু মারা যায়।
আমেরিকার রাজনীতিতে মিথ্যাচার নিয়ে লেখা এক বইয়ে অধ্যাপক বেঞ্জামিন গিনসবার্গ বলেন, প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যাচারের পরিণতি ছিল ভয়াবহ। অথচ মাকিন জনগণ এক সময় তাদের প্রেসিডেন্টদের শিশুর মতো সরলভাবে বিশ্বাস করতেন। মানুষের কাছে প্রেসিডেন্টের অবস্থান ছিল অনেকটা ঈশ^রের মতো। কখন তা বদলে গেল?
ইতিহাসবিদরা বলছেন, লিন্ডন বেইনস জনসনের সময় থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল মিথ্যাচারের শুরু। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তি খাড়া করতে জনসন ১৯৬৪ সালে টনকিন উপসাগরে একটি নৌ-হামলার কথা বলেন, যেটি আদৌ কখনো ঘটেনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর আড়িপাতার ঘটনা ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারির জেরে ক্ষমতা হারান প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে নিয়ে বিখ্যাত এক গল্প রয়েছে যেখানে বাগানের চেরিগাছ কুড়াল দিয়ে কাটার পর তিনি নিজেই তার বাবার কাছে গিয়ে দোষ স্বীকার করে বলছেন, আমি মিথ্যা বলতে পারি না বাবা। কিন্তু প্রেসিডেন্টের জীবনীকার পরে স্বীকার করেন যে, ওই গল্পটি তিনি স্রেফ বানিয়ে লিখেছেন।
হোয়াইট হাউসের বাসিন্দাদের কিছু কিছু মিথ্যাচার রীতিমতো আকাশকুসুম কল্পনার মতো।
যেমন, প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীকে বলেছিলেন, আমেরিকার জনমানবশূন্য পশ্চিমাঞ্চলে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে পশমাবৃত ম্যামথ (অতিকায় হাতি) বিচরণ করে বেড়ায়!
১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বলেন, ইউরোপে মার্কিন বাহিনীর সিগনাল কোরের আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি নাৎসি বন্দি শিবিরে নির্যাতনের ছবি তুলেছেন। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকার বাইরেই কখনো যাননি।
রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার নিয়ে এক বইয়ে অধ্যাপক এরিক অলটারম্যান বলেন, আমেরিকা রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যাচার মানুষ সহ্য করেছে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে অতীতের সব সীমা অতিক্রম করে যান।
মিথ্যাচার নিয়ে বিল ক্লিনটনের নির্লজ্জতাও ছিল অবিশ্বাস্য। ১৯৯৮ সালে জানুয়ারিতে ইনটার্ন মনিকা লিউনিস্কির সঙ্গে তার যৌন সম্পর্কের অভিযোগ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে জোর গলায় অস্বীকার করেন তিনি। যদিও পরবর্তী তদন্তে সব মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যায়।
১৯৯৮ সালের আগস্টে এ নিয়ে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারের আগে তিনি এক বন্ধুকে বলেন, ওই মিথ্যা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
অথচ হোয়াইট হাউসের যে ঘরে রাষ্ট্রীয় ভোজসভা হয়, সেখানে ফলকের ওপর খোদাই করে লেখা রয়েছে,
এই ছাদের নিচে শুধু তারাই আসেন, যারা সৎ, জ্ঞানী ও সুশাসক!