চিকেন পক্স (Chicken pox) বা জলবসন্ত হল একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিক রোগ। এই রোগে সমস্ত শরীরে চুলকানি যুক্ত ফুসকুড়ি বা লাল দাগ বা ফোস্কা পরে যায়। এটা Varicella zoster ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত শিশুদের চিকেন পক্স হওয়ার প্রবণতা বেশী, কিন্তু প্রায় সকলেই জীবনে অন্তত একবার চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়। এই রোগে এমনকি ৪ সপ্তাহের শিশুও চিকেন পক্সে আক্রান্ত হতে পারে যার জটিলতা খুব দ্রুত বেড়ে যেতে পারে।
সংক্রামক রোগ হওয়ায় এ রোগটি খুব সহজেই ছড়িয়ে পরে। এটি আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীর থেকে বাতাসবাহিত দূষিত কণার মাধ্যমে ছড়িয়ে পরতে পারে অথবা একজন সুস্থ্য ব্যাক্তি যখন আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরের থেকে ফোস্কা থেকে নির্গত দূষিত তরলের সংস্পর্শে আসে তখন সংক্রমিত হতে পারে। একজন চিকেন পক্সে আক্রান্ত ব্যাক্তি এমনকি তার মধ্যে এর লক্ষণ না দেখা গেলেও এ রোগ ছড়াতে পারে।
চিকেন পক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে আছে জ্বর, মাথা ব্যাথা, এবং গলা ব্যাথা। প্রথম উপসর্গ দেখা দেওয়ার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে রোগীর শরীরে লাল রঙের ফুসকুড়ির দাগ দেখা দেয়। পানি যুক্ত এই লালচে গোটা ফেটে গেলে তা আরও বেশি মাত্রায় ওঠা শুরু করে। দাগগুলি উপসর্গ প্রকাশের শুরু থেকে ১০ দিনের মধ্যে শুকিয়ে যেতে থাকে।
ঋতু পরিবর্তনের পর গরম পড়ার সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়ে যায় ভাইরাসজনিত সিজনাল ডিজিস চিকেন পক্স এর প্রকোপ। আমরা একটু সাবধানে থাকলেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রেহাই পেতে পারি। আসুন জেনে নেওয়া যাক, কী কী সাবধানতা অবলম্বন করলে আমরা রক্ষা পেতে পারি চিকেন পক্স থেকে।
চিকেন পক্স রোগের লক্ষণ (Symptoms)
ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ, হাঁচি-কাশি এবং ব্যবহৃত জিনিষপত্রের মাধ্যমে এটি বেশি ছড়ায়। এ রোগে চুলকানিসহ লালচে পানিযুক্ত গোটা হয়। এ সময় শরীর কাজ করার অনিচ্ছা প্রবলভাবে লক্ষ্যনীয়; হালকা ব্যথা হয়, জ্বর হয়, গায়ে ছোট ছোট ফুসকুড়ি বা র্যাশ উঠে। সাধারণতঃ এ ফুসকুড়ি বুকে-পিঠে বেশী দেখা যায়, তবে, সারা শরীরই এই ফুসকুড়িতে আক্রান্ত হয়।
চিকেন পক্স হলে যে সব সাবধানতা নিতে হবে (Cautions)
১. ভ্যাকসিন গ্রহন (গর্ভবতী ও ক্যান্সারে আক্রান্ত থেরাপী গ্রহনরত ব্যক্তিরা ছাড়া)
২. নিয়মিত হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করা।
৩. দিনে কমপক্ষে ৫ বার হাত ধোয়া। বিশেষ করে প্রতিবার বাইরে থেকে ফেরার পর ও খাবার গ্রহনের আগে।
৪. মানুষের ভীড় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা।
৫. আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা ও তার ব্যবহৃত জিনিস না ধরা।
চিকেন পক্স হলে যে কাজগুলো করবেন না
১। ঠাণ্ডা খাবার খাবেন নাঃ এই সময় যেকোনও খাবারই একটু গরম-গরম খাবেন। ঠাণ্ডা খাবার একদম খাবেন না। বিশেষ করে ফ্রিজের খাবার ছুঁয়েও দেখবেন না।
২) প্রচুর পানি পান করুনঃ জলবসন্ত হলে রোগীর মুখের স্বাদ চলে যায়। এ সময় পানি পান করতে ইচ্ছা করে না, বিধায় পানি রোজ নিয়ম করে পান করুন ।
৩) ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ খাবেন না।
৪) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুনঃ এই রোগের সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকাটা খুবই জরুরি। তা নইলে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এ রোগ পরিবারের অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে দ্রুত।
৫) হালকা গরম পানিতে গোসল করুন। সাবান পানি দিয়ে পক্স ধুতে পারবেন, তবে, বেশি জোরে ডলা দিলে ফুসকুড়ি ফেটে যেতে পারে। এ ব্যাপারে সাবধান থাকা।
৬) ফোস্কা ফাটাবেন না।
যেভাবে চিকেন পক্স ছড়িয়ে পড়ে
১. আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি ও কফ থেকে এ রোগ ছড়ায়।
২. সেবক/সেবিকা যদি রোগীর ফেটে যাওয়া ফোস্কা থেকে নির্গত তরলের সংস্পর্শে আসে, তাহলে ছড়াতে পারে।
৩. রোগী ও তার ব্যবহৃত জিনিসের স্পর্শে জলবসন্ত ছড়ায়।
চিকেন পক্স হলে চিকিৎসা কি? (Treatment)
- চিকেন পক্স হলে দ্রুত একবার ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই রোগে নিয়ম মেনে চললে ১০-১৫ দিনের মধ্য জলবসন্ত ভাল হয়ে যায়।
- বাইরে বের হতে দেয়া যাবে না। এতে বাইরের বাতাসে পক্স শুকাতে দেরি হতে পারে।
- চিকেন পক্সে সাধারণতঃ বিশেষ কোন ধরণের ওষুধ প্রয়োজন হয় না। তবে, চিকেন পক্স হলে শরীরে অসহ্য চুলকানি অনুভূত হওয়ায় চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও মলম ব্যবহার করতে হবে।
- চিকেন পক্স হলে সেপসিস, এনকেফালাইটিস, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই, এসবের চিকিৎসা করানো প্রয়োজন।
জলবসন্ত হলে কি কি খাওয়া যাবে
- সাধারণ ভাত, মাছ, মাংস, স্যুপ খেতে পারবেন।
- মুখে ঘা থাকলে নরম ফল খাবেন।
- দিনে কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি।
জলবসন্ত হলে কি কি খাওয়া নিষেধ
- এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার যেমন, চর্বিযুক্ত গোস্ত, বা, ফুট-ফ্যাট দুধ দেয়া যাবে না।
- চকোলেট, বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবারগুলো পরিহার করা উচিত।
- জলবসন্ত মুখের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে লেবু খাবেন না।
চিকেন পক্সের জন্য কিছু গৃহ চিকিৎসা
১. বেকিং সোডাঃ বেকিং সোডা চামড়াকে পরিষ্কার করে এবং জ্বলুনি কমায়। এক গ্লাস পানিতে আধা চা চামচ বেকিং সোডা গুলিয়ে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে এই সলিউশন দিয়ে মুছে দিন। যখন বেকিং সোডা চামড়ার উপরে শুকিয়ে যাবে, চুলকানি বন্ধ হয়ে যাবে।
২. মধুঃ মধু ক্ষত সারিয়ে তুলতে এবং এর দাগ দূর করার ক্ষমতা আছে। মধু প্রয়োগ করলে ফোস্কা গুলি সেরে উঠবে এবং চুলকানি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। দিনে ২ থেকে ৩ বার ক্ষতস্থানের শুকনা আবরণের উপর মধু মেখে দিন, ক্ষত দূর হয়ে যাবে।
৩. ওট মিলঃ চুলকানি কমাতে এক লিটার পানিতে দুই কাপ ওট মিল পাউডার নিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে গুলে নিন। এই মিশ্রণটি কাপড়ের ব্যাগে নিয়ে মুখ বেধে নিন। ব্যাগটি গোসলের পানিতে ছেড়ে দিন এবং পানি দুধের মত সাদা দেখতে হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এই পানি দিয়ে গোসল করুন।
৪. নিমঃ নিমপাতা বাটা দিয়ে তৈরি পেস্ট চুলকানি কমায় এবং দ্রুত আরোগ্য করে। নিমপাতা পানির সাথে মিশিয়ে বেটে পেস্ট তৈরি করে ফোস্কার উপর প্রয়োগ করুন। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে এটি ধুয়ে ফেলুন।
৫. হলুদঃ চুলকানি কমাতে এবং দ্রুত সেরে উঠতে ২-৩ চা চামচ হলুদযুক্ত গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন।
৬. বাদামী ভিনেগারঃ ১/২ কাপ বাদামী ভিনেগার গোসলের জন্য মৃদু গরম পানিতে মিশিয়ে নিন। পোড়ানি থেকে মুক্তি পেতে এবং সংক্রমিত ক্ষত সারিয়ে তুলতে এই পানি দিয়ে গোসল করুন।
৭. ভিটামিন ই (Vitamin E) তেলঃ ত্বকের উপর ভিটামিন ই তেল মাখুন। এটি চিকেন পক্সের ফোস্কা এবং এর চিহ্ন গুলির নিরাময়েও সাহায্য করে।
৮. Calamine লোশনঃ Calamine লোশন চুলকানি দূর করে। গরম পানি দিয়ে গোসল করে শরীর শুকিয়ে নিন। এবার, ত্বকের উপরে Calamine লোশন মাখুন। দিনে ২-৩ বার লোসন দিন।
জল বসন্তের দাগ দূর করার উপায়

১) ডাবের পানির ব্যবহার
- ডাবের পানি বসন্ত সেরে যাওয়ার ঠিক পরপরই তুলোর বলের মাধ্যমে সরাসরি আক্রান্ত স্থানে লাগাবেন।
- ২ গ্লাস ডাবের পানি গোসলের পানিতে মিশিয়ে নেবেন।
- প্রতিদিন অন্তত ১ গ্লাস ডাবের পানি পানের চেষ্টা করবেন।

২) বেকিং সোডার ব্যবহার
- ২ টেবিল চামচ বেকিং সোডাতে সামান্য পানি মিশিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করে ফেলুন।
- এরপর এই পেস্ট আক্রান্ত স্থানে স্ক্রাবের মতো ব্যবহার করুন। ত্বকে লাগিয়ে আলতো ঘষে নিন ১-২ মিনিট।
- এরপর পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে প্রতিদিন করুন।

৩) লেবুর রসের ব্যবহার
- ১ চা চামচ লেবুর রস বের করে নিন। একটি তুলোর বল এই লেবুর রসে ভিজিয়ে আক্রান্ত স্থানে ভালো করে লাগিয়ে নিন।
- ১০ মিনিট এভাবে রেখে দিন। এরপর পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন।
- মনে রাখবেন নিয়মিত এই লেবুর রস ব্যবহারের কারণে আপনার ত্বক ফটোসেনসিটিভ হয়ে যায়, তাই রোদে বেরুলে অবশ্যই ভালো মানের সানস্ক্রিন ব্যবহার করে ফেলুন।
চিকেন পক্সের টিকা কখন দেয়া উচিত?
শিশুর জন্মের এক বছর পর থেকেই চিকেন পক্সের টিকা দেয়া যায়। এর ডোজ একটি। এক বছর পরে যে কোন সময় দেয়া যায়।
স্বস্তিকর খবর
স্বস্তিকর খবর হল, যারা একবার জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন, তারা সাধারণতঃ এই রোগে আর আক্রান্ত হন না।
জলবসন্ত নিয়ে এই লেখাটি জনপ্রিয় চিকিৎসা পোর্টাল webmd এর লেখা অবলম্বনে লেখা হয়েছে।
Photo Source: oggi.jp