এই কথাটা সবাই জানেন যে, সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষদের চাইতে বেশি দিন বাঁচেন – অন্যভাবে বলা যায়, বেঁচে থাকেন। বছরের পর বছর পশ্চিমের জনগণ বিস্ময়ের সাথে জাপানীদের জীবনযাত্রা দেখে আক্ষেপে নিজেদের মাথার চুল ছিড়ে ফেলছে – তারা দেখেছেন কিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ক্ষুধা-দারিদ্র-পীড়িত কম-আয়ুর জাপানীরা কিভাবে বিশ্বের দীর্ঘায়ু মানুষের দেশে পরিণত হয়ে উঠেছে।
জাপানীদের এই অর্জন কিভাবে সম্ভব হল? মিলিয়ন ডলারের এই প্রশ্নের কোন নির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা নেই – বছরের পর বছর বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও স্থানীয় উপকথার উপরে ভিত্তি করে এই প্রশ্নের কিছু উত্তর দাঁড় করানো গিয়েছে – এই উত্তরগুলোর সারসংক্ষেপ পাঠকদের উদ্দ্যেশ্যে নিবেদন করা হয়েছে এই লেখাতে।
সূচীপত্র
১। প্রচুর পরিমাণে শাক-শব্জি খাওয়ার অভ্যাস

প্রথাগতভাবে, জাপানীদের খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণে ভাত, শাক-সব্জী এবং গোস্ত থাকে – সাধারণতঃ এই ক্রমিকেই খেয়ে থাকেন – এছাড়াও সয় ও সামুদ্রিক-মূল (soy and seaweed) জাতীয় খাবারের আইটেমে রয়েছে জাপানীদের আজন্ম আকাঙ্খ। আর এই ধরণের খাদ্য তালিকার জন্য জাপানীরা তাদের শরীরের জন্য পেয়ে থাকেন প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেলস এবং সমুদ্রজাত কেমিক্যাল পুষ্টি (beneficial phytochemicals)।
এবার একটু দেখে আসি পশ্চিমারা কি খাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমরা দেখেছি যে, ঊনিশ শতক থেকে পশ্চিমাদেরকে সুকৌশলে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত করে ফেলা হয়েছে – পোড়া ও বাসি গোস্ত আর তার সাথে সম্প্রতি যুক্ত করা হয়েছে সাদা ব্রেড, রিফাইন্ড চিনি এবং প্রায় সব খাবারের সাথে গ্রহনযোগ্য মাত্রার থেকে বেশি মিষ্টি দেওয়ার প্রবণতা।
২। খাদ্য রান্না করার ভিন্ন পদ্ধতি

টেম্পুরা, টংকাটসু এবং ক্রোকেট (এক ধরণের ভেজিটেবল রোল) – এই ধরণের জাপানী খাবারগুলো সাধারণতঃ বাষ্প দ্বারা (steaming) সিদ্ধ করা হয়, প্যানে করে গ্রিল করা (pan-grilling), ব্রোলিং (আঁচে রান্না) (broiling), স্টির-ফ্রায়িং (তাওয়াতে রান্নার সময় অনবরত নাড়াচাড়া করা, stir-frying), স্লো-কুকিং (slow-cooking) এবং ফারমেন্টিং (গাজানো, fermenting)।
জাপানীদের প্রথাগত খাবারের অভ্যাসের মধ্যে অন্ততঃ এক বাটি স্যুপ থাকবেই এবং এর সাথে রয়েছে অন্যান্য খাবার। তাদের দীর্ঘায়ু হবার রহস্যের মধ্যে একটি হল, তারা ভেজিটেবল এর সাথে মাছ খেয়ে থাকে, আর এর সাথে রয়েছে সীম ও ভাত। মনে রাখতে হবে, সীমে রয়েছে প্রচুর ফাইবার বা আঁশ।
৩। জাপানীরা প্রচুর চা পান করেন

জাপানীদের মধ্যে কফি পান করার প্রচলন তেমন না হলেও – জাতি হিসাবে জাপানীরা ঐতিহ্যগতভাবে প্রচুর চা পান করেন – আর জেনে অবাক হবেন যে, জাপানীদের চা এ কফির চেয়ে অনেক, অনেক বেশী এন্টি-এক্সিডেন্ট রয়েছে।
জাপানীদের চা-পানের আসরের বিশেষত্ব হলঃ মাচা (Matcha), এক ধরণের ভাল মানের “গ্রিন চা” বা “গ্রীন টি” (green tea)। এই গ্রিন টি’তে কফির চাইতে অনেক বেশি পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। জাপানীদের মাচা গ্রিন টি’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল – এটি পাউডার আকারে পাওয়া যায়; আর বলে নেয়া ভাল, সে দেশে এটি একটি কুলীন পণ্য – তাই দামও বেশী। আর, এটি চা বাগানের বাছাই করা কচি পাতা থেকে তৈরী করা হয়। এই পাতার বৈশিষ্ট্য হল – এটিকে সূর্যের আলোতে থেকে রক্ষা করে ছায়ায় বেড়ে তোলা হয়, যাতে এতে সবুজ ক্লোরোফিল বেশি পাওয়া যায়।
৪। ফ্রেশ খাবার

জাপানীদের দীর্ঘায়ু লাভের আরেকটি কারণ হল তারা ফ্রেস খাবার ছাড়া অন্য কিছু মুখে দেন না। কিন্তু, কতটা ফ্রেস? ফ্রেস খাবারের ব্যাপারের জাপানীরা সিরিয়াস রকমের সচেতন। দ্বীপ রাষ্ট্র জাপানের কৃষি কাজের উপযোগী জমির পরিমাণ অনেক। এখানে এত খাদ্য উৎপন্ন হয় যে, মানুষের মুখে যাবার আগে জমি থেকে খাদ্যকে খুব বেশী দূর ভ্রমন করতে হয় না – জাপানে মাছ ও শষ্যের চেয়ে শাক-শব্জীর জন্য কথাটা বেশী প্রযোজ্য।
জাপানের মার্কেটগুলো সম্পর্কে একটি চমৎকার তথ্য হচ্ছে, এখানে খাদ্যদ্রব্য কখনও এক দিনের বাসি হয় না, বড়জোর আধা ঘণ্টা। এই তথ্যটি সামনে নিয়ে আসেন নাওমি মরিয়াম (Naomi Moriyama)। তার রচিত “Japanese Women Don’t Get Old or Fat” গ্রন্থে এই তথ্যটি উঠে এসেছে।
[adinserter block=”1″]
৫। জাপানীরা ছোট প্লেটে খাওয়া-দাওয়া করে

জাপানীদের ঐতিহ্যগত রান্নার পদ্ধতিতে রয়েছে একটি বিশেষ ধরণের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। ভদ্রতাবোধ জাপানীদের লাইফস্টাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ – এর মধ্যে রয়েছে খাবারের সময় চপস্টিকের সঠিক ও সযত্ন ব্যবহার, ছোট প্লেট বা ভাতের বাটি থেকে খাবারের প্রথা, খাবারকে কম ডেকোরেট করা, প্রতিটি তরকারী বা ডিসকে ছোট বাটিতে পরিবেশন করা এবং প্রতি জনের জন্য খাবারের প্লেটে খুব কম পরিমাণে খাবার দেওয়া।
জাপানের ওকিনাওয়া’র স্থানীয় মানুষদের ভাষ্য থেকে তাদের দীর্ঘায়ু রহস্যের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। তারা তাদের ভাষায় বলে থাকেন, “hara hachi bu” অর্থাৎ “খেতে থাক যতক্ষণ না তোমার পেটের ৮০% পূর্ণ হচ্ছে”।
৬। হাটা, দাঁড়ানো এবং দাঁড়িয়ে ব্যায়াম

জাপানের রয়েছে সুশৃঙ্খল গণ পরিবহন ব্যবস্থা – সকালে কাজের উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়া, রেল স্টেশনে পৌঁছাও, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা, ট্রেনে উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়া, এরপর ট্রেন থেকে নেমে কর্মস্থলে হেটে যাওয়া এবং একটি কর্মব্যস্ত দিন শুরু করা।
জাপানীরা দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য সাধারণতঃ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে থাকে। তারা বাইসাইকেলে চড়তে ভালবাসেন এবং ট্রেনে চড়া তাদের কালচারের অংশ – ব্যক্তিগত গাড়ি কেনাকে তারা বিলাসিতা হিসাবে গণ্য করেন। এমনকি ক্যানন’র মত কোম্পানীর কর্মকর্তারা অফিসের মধ্যে দাঁড়িয়ে কর্মব্যস্ত সময় কাটান।
এমনকি জাপানীদের বাথরুমগুলো অন্যদের থেকে আলাদা। জাপানে অনেক টয়লেট পশ্চিমা ধাঁচে গড়ে উঠেছে, কিন্তু, এখনও পুরান ধাঁচের স্কুল্গুলোর টয়লেটে কমোডের ব্যবস্থা করা আছে যেখানে হাটু ভাঁজ করে বসতে হয়, যেটা বাজ্য ত্যাগ করার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল।
৭। রেডিও প্রোগ্রাম ধরে সকালের ব্যায়াম করা

জাপানে রয়েছে “Radio Taiso”। এটি একটি রেডিও/টিভি-নির্ভর খালি হাতে ব্যায়াম করার রুটিন যা প্রতি দিনই প্রচারিত হয়। জাপানের প্রতিটি স্থানে বহু সংখ্যক জাপানীরা প্রতিদিন সকালে এই ব্যায়ামগুলোতে অংশগ্রহন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস’র অধুনা বিলুপ্ত MetLife, Inc. কোম্পানী ১৯২০ এর দশকে জাপানের যোগাযোগ ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের পরিদর্শন আসে। এই মেটলাইফের একটি স্বাস্থ্য প্রোডাক্ট হিসাবে radio calisthenics (রেডিও ক্যালিসথেনিক্স) চালু করা হয়েছিল। গণস্বাস্থ্যের মান উন্নয়নে এই রেডিও ও টিভি প্রোগ্রাম গভীর ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। জাপানীদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন, সচেতনতা ও এনার্জি লেভেল প্রভূত উন্নতি হয় – তারা তাদের কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাক্ষেত্রে আরও সাবলীলভাবে কাজ করতে পারছেন, কাজের মনোযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে।
৮। জাপানীদের রয়েছে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা

১৯৬০ এর দশকে, জাপানের একটি বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রয়েছে; এতে জিডিপির মাত্র ৮% অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। এর বিপরীতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতিতে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় জাপানের থেকে অর্ধেকের চেয়ে কম অর্থ প্রদান করে।
জাপানের বর্তমান স্বাস্থ্যসেবায় জাপানীদের সকলে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়েছে। জাপানীরা স্বাস্থ্য চেক-আপের জন্য গড়পড়তায় বছরে ১২ বারের মত চিকিৎসকের চেম্বারের ঢুঁ মারেন – আর সংখ্যাটির যুক্তরাষ্ট্রের থেকে চারগুণ বেশি।
৯। জাপানীরা বাহিরে বেশি ঘুরতে পছন্দ করেন

বাস্তবে সর্বত্র হাঁটার পাশাপাশি, বন্ধুবান্ধবদের সাথে নিয়ে খাবার জন্য বাসায় দাওয়াত না দিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে পছন্দ করে। এটাই জাপানীদের সামাজিক প্রচলন।
জাপানের বাসস্থানগুলি ছোট, অন্যদিকে রেস্টুরেন্টে খাবারের দাম অপেক্ষাকৃত সস্তা – তাই বাইরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করাটাই জাপানীদের একটি নিয়মিত ঘটনা। যদিও জাপানীদের বাইরে এই খাবারের অভ্যাস তাদের দীর্ঘ জীবনের উপরে কোন প্রভাব ফেলে কিনা তা জরিপ করে দেখা হয় নাই, কিন্তু, সামাজিক বন্ধন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শুধু জাপানীদেরই নয়, সকলের মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১০। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপরে গুরুত্ব

এক কথায় বলতে গেলে, জাপানীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুবই সতর্ক – এই ব্যাপারটি তাদের রক্তে মিশে আছে। তাদের কালচারাল প্রথা ও পদ্ধতিগুলোর সিংহভাগে অনুসরণ করা হয় শতাব্দী পুরানো একটি প্রথা, শিন্টোইজম (Shintoism) – এর শিন্টোইজমের মূল বিষয়টিই হল “পরিশুদ্ধতা অর্জন” (purification)। সাধারণতঃ গরমের ঋতুতে দিনের দুইবার গোসন করা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। আর, অনেকে মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে গোসল (communal baths) করাও তাদের নিয়মিত একটি ব্যাপার; যদিও এর জন্য বেশ কিছু কঠোর নিয়ম ও রীতি-নীতি অনুসরণ করা হয়।